প্রখ্যাত বাংলা নাটক-পথনাটিকা নবজাগরন-তৎকালীনগ্রাম্য সমাজের পিছিয়ে পড়া মা বোনদের এগিয়ে যাওয়ার এক আসম প্রচেষ্টা ।
আসানসোলের কোর্টমোড়রোডে কমনওয়েলথ গেমসের শোভাযাত্রা যাবে এবং সেই অনুষ্ঠানে গেমসের মশাল হস্তান্তর করবেন বারাবাজার ব্লকের তৎকালীন বি.ডি.ও মহাশয় দেবজিৎ বোস সময় মাত্র ২০ মিনিট সেই স্বল্প সময়ে পথনাটিকা “নবজাগরন” অভিনিত হয়েছিল জনশিক্ষা নাট্য গোষ্ঠীর অখ্যাত শিল্পীদের দিয়ে ।এবং উক্ত পথনাটিকায় বি.ডি.ও এর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বি.ডি.ও দেবজিৎ বোস মহাশয় ।তখনকার বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতেও উক্ত পথনাটিকাটির সুখ্যাতি প্রকাশিত হয়েছিল ।সেই পথনাটিকাটি হুবহু তুলে ধরা হল ।
বাস্তবধর্মী পথনাটিকা
[“নবজাগরন”]
রচনা ও পরিচালনা:-ধীরেন মন্ডল
সম্পাদনা:-দেবজিৎ বোস
চরিত্রলিপি
বিমলবাবু:-মধ্যবৃত্ত গৃহস্হ
সনাতন:-ওর ছেলে
ঝগড়ু:-মদ মাতাল
স্বপন:-ক্রীড়ামোদী
কবিতা ও কল্পনা:-বিমলের মেয়ে
লক্ষী:-ঝগড়ুর মেয়ে
বি.ডি.ও. ও দেহরক্ষী
[ বিমল খুড়োর বাড়ির উঠোন ]
ডাকতে ডাকতে বিমল আসে
বিমল- কবিতা, কল্পনা ,বৌমা - যা বাবা সারা বাড়ি খাঁ খাঁ করছে সব গেল কোথায় ?
[ সনতন এসে বলে ]
সনাতন- কি হলো বাবা ডাকছো কেন ?
বিমল- কি ব্যাপার সনাতন, সন্ধে প্রায় হয়ে এলো তবু কবিতা,কল্পনা,বৌমা- সব গেল কোথায় ।
সনাতন- কবিতা , কল্পনাকে তুমি কোথায় পাবে বাবা, তারা তো ভোরবেলাতেই স্বপনদার সাথে পুরুলিয়ায় গেছে খেলার জেলা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করতে ।
বিমল- ও: সে কথা আমার একেবারেই মনে ছিল না ।আর বৌমা কোথায় বৌমা ?
সনাতন- তোমার বৌমা গেছে স্বনির্ভর দলের মিটিং করতে ।আর দেরি নেই এল বলে ।
বিমল- তাই নাকি!বৌমা এই সন্ধে বেলায় গেছে স্বনির্ভর দলের মিটিং করতে ।বুঝলে সনাতন বাড়ির বৌদের এত অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া আমার মোটেই পছন্দ নয় । তোমার মা কোনোদিন ভুলেউ বাড়ি থেকে বেরোত না । আর আজ তার মেয়ে ,বৌমা…….
সনাতন- আজ কাল আর সেই আগের দিনের কথা ভেবে কোনো লাভ নেই বাবা ।মেয়েরা আজ চার দেওয়ালের বদ্ধ জীবন থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষা,দীক্ষা ,খেলাধুলা প্রতিটি ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে আজ তারা সমান অধিকার আদায় করেছে ।
বিমল- কিন্তু!
সনাতন-কোন কিন্তু নয় বাবা । আমাদের এই অজ পাড়া গ্রামটার দিকে তাকিয়ে দেখলেই তুমি দেখতে পাবে-মেয়েরা আজ অগ্রনী ভূমিকা নিয়ে শিক্ষা, স্বাস্হ তথা গ্রাম উন্নয়নের কাজ করে গ্রামটার চেহারা পাল্টে দিচ্ছে ।
বিমল- তা অবশ্য ঠিকি আজ প্রতিটি ক্ষেত্রে গ্রামটার সেই আগের অবস্হার আমূল পরির্বতন ঘটেছে ।
সনাতন- আচ্ছা বলো তো বাবা, তোমার মতো একজন গরীব চাষীর মেয়ে –কবিতা , কল্পনা বরাবাজার কলেজে লেখাপড়া শিখবে,খেলাধুলায় জেলা প্রতিযোগিতায় সুযোগ পাবে,একথা কি কোনোদিন কল্পনাও করেছিলে ?
বিমল- সত্যিই সনাতন সবকিছুই আজ আশ্চর্য মনে হচ্ছে ।
সনাতন- বল তো বাবা,ঝগড়ু মাতালের মেয়ে লক্ষী যে শিশুশ্রমিক স্কুলে লেখাপড়া শিখছে দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম স্হান পেয়ে গ্রামের মুখ উজ্জল করবে, তা আমরা কি কোনোদিন স্বপ্নেও ভেবে ছিলাম ?
[ পুরুলিয়ার গ্রাম্য ভাষা ]
(ডাকতে ডাকতে ঝগড়ু মাতাল এসে বলে)
ঝগড়ু- বিমলদা_ বিমলদা_ কই আমার মেয়ে লক্ষী বিটির পুরুল্যা থাকে এখনও গুরে আল্য নাই ।সকাল বেলায় স্বপনের সঙে গেল,সাজ হতে চলল কি আমার লক্ষী ত এখনও আল্য নাই ?
বিমল- আসছে আসছে ঝগড়ু, আসার সময় হয়ে গেছে ।আমার মেয়ে কবিতা আর কল্পনাও তো গেছে ।
সনাতন- ঝগড়ু কাকু,গতকাল গ্রামে মদভাটি নিয়ে এত কান্ড হলো, তবু তুমি আবার মদ খেয়েছো ?
ঝগড়ু- বলিস্ না বাপ কাওকে বলিস না ।কাল সকাল থেকে আজ অবধি এক ফঁটা মদ পাই নাই ।গাঁয়ের স্বনির্ভর দলের মেয়া গিলা, মদভাটি ভাঙে,মদ ভাটিয়াল ভকা আর গমদাকে উত্তম মধ্যম দিঁয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে ।কত চেষ্টায় আজ এই মালটুকু পাঁয়েছি-আঃ আকাটা মাল মধু মধু [মদ খায়]
বিমল- বুঝলে ঝগড়ু মানুষ হতে শিখলে না,মদ খেয়ে চিরকাল মাতাল হয়েই রয়ে গেলে ।
ঝগড়ু- উ কথা বল না বিমলদা,মদ আমি যতই খাই তবু মাতাল আমি হব নাই ।
সনাতন- আচ্ছা ঝগড়ু কাকু,তোমার মেয়ে লক্ষী পুরুলিয়া থেকে এসে তোমাকে যদি এই মাতাল অবস্হায় দেখে ,তাহলে তার মনে কি দুঃখ হবে এক বার ভেবে দেখেছো ?
ঝগড়ু- না বাপ না আমার ঐ দূঃখী মেয়াটার মনে আর আমি দূঃখ দিব নাই ।মেয়াটা আমার ছাগল বাগালী করে কত কষ্ট করে গাঁয়ের ইস্কুলে যখন লেখাপড়া শিখছে,খেলাধুলায় কত পাইজ আনছে,কতনাম পাছে-তখন ঐ দূঃখী ঐ বিটিটাকে আর আমি দূঃখ দিব নাই ।
[ বি.ডি.ও. সাহেব আসেন,দেহরক্ষী সাথে ]
বি.ডি.ও.- নমস্কার-বিমলবাবু-নমস্কার !
বিমল- একি! বি.ডি.ও. সাহেব-নমস্কার আসুন আসুন-
সনাতন-[চুপিসারে] ঝগড়ু কাকু, বি.ডি.ও. সাহেব এসেছেন নমস্কার কর ।
ঝগড়ু- তাই নাকি ! পণাম স্যার পণাম
ঝগড়ু- তাই নাকি ! পণাম স্যার পণাম
[ ঝগড়ু মাটিতে গড়াগড়ি দেয়]
বি.ডিও.- উঠুন ঝগড়ুবাবু উঠুন ।আমি প্রথমদিন আপনাদের গ্রামে এসেছিলাম, যেদিন আপনাদের সারা গ্রামের স্বনির্ভর দলের মেয়েরা চোলাই মদের ভাটি ভেঙে আমার কাছে ডেপুটেশন দিয়েছিল চোলাই মদ বন্ধ করবার জন্য ।আর আজ দ্বিতীয় বার এলাম আপনাদের মেয়েরা যখন কৃতীত্বের প্রমান রেখে জেলা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করতে পুরুলিয়া গেছে ।পুরুলিয়ার লাল কাকুঁড়ে মাটির বরাবাজারের অজঃ গ্রামেও যে মনি মুক্তোর ফুল ফোটে,তা আজ আমি নিজের চোখে দেখতে পেলাম ।
সকলে- স্যার..
বি.ডি.ও.- ঝগড়ু বাবু আপনাদের গ্রামের মেয়েরা সমবেত প্রচেষ্টায় চোলাই মদ বন্ধ করার পরও আপনি মদ খেয়ে আপরাধ করেছেন,সেকথা বুঝতে পারছেন?
ঝগড়ু- আমাকে ক্ষমা করে দেন স্যার-মদ খাঁয়ে আমি মহা অপরাধ করে ফেলেছি স্যার ।জীবনে এমন ভূল আর আমি করব নাই স্যার-আমি এই কান ধরে উঠবোস করে বলছি ।[উঠবোস করে]
সকলে- না ঝগড়ু না তুমি থামো..
ঝগড়ু- না না বিমলদা দোষ যখন করেছি শাস্তি আমি লিবই ।
সনাতন- ঐ দেখ বাবা স্বপনদা সবাইকে নিয়ে পুরুলিয়া থেকে ফিরে এসেছে ।
বিমল- তাই নাকি! কবিতা , কল্পনা , লক্ষী সবাই এসে গেছে ?
ঝগড়ু- কি আমার লক্ষী কই ?
সনাতন- লক্ষী ও আসছে কাকু-ঐ দেখ সবাই আসছে ।
[ স্বপন এসে বলে ]
স্বপন- নমস্কার কাকা বাবু নমস্কার ।একি!স্যার আপনিও এসেছেন! নমস্কার স্যার নমস্কার ।
বি.ডি.ও.- কি স্বপন পুরুলিয়ার সব খবর ভালো তো ?
স্বপন- হ্যাঁ স্যার খুব আনন্দের সংবাদ আছে ।
সকলে- আনন্দ সংবাদ ।
স্বপন- হ্যাঁ ভীষন আনন্দের সংবাদ স্যার ।কবিতা লংজাম্পে আর কল্পনা হাইজাম্পে জেলার প্রথম হয়েছে ।
সকলে- তাই নাকি!
ঝগড়ু- আর আমার লক্ষী ?
স্বপন- লক্ষীর সাফল্য শুধু আমাদের বারাবাজার থানা নয় কাকু,সারা পুরুলিয়া জেলার সুনাম বেড়ে গেছে । লক্ষী ১০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় জেলার প্রথম শুধু নয়-জেলার সর্বোচ্চ রেকর্ড করেছে ।
সকলে- তাই নাকি!
ঝগড়ু- কুথায় আমার মা লক্ষী কুথায় ?
[প্রাইজ হাতে লক্ষী , কবিতা ও কল্পনা আসে ]
ঝগড়ু- [লক্ষী প্রনাম করে] লক্ষী মা আমার-[মাথায় হাত দেয়]
লক্ষী- বাবা তুমি আবার মদ খেয়েছো ?
ঝগড়ু- ওঃ না মা না আর আমি মদ খাব নাই ।বি.ডি.ও. সাহেব আমার চোখ ফুটায় দিয়েছে ।আজ আমি পিতিজ্ঞা করছি মা,জীবনে আর মদ খাব নাই ।এই শেষ খাওয়া-[বোতল ফেলে দেয়]
বিমল- [কবিতা ও কল্পনা প্রনাম করে] ওঠো মা ওঠো । আজ আমার মনে হচ্ছে সত্যিই আমি ভাগ্যবান বাবা ।গর্বে আজ আমার বুকটা ভরে গেছে ।তোমরা আজ শুধু আমার মুখ উজ্জল করনি,এই গ্রাম ও সারা পুরুলিয়া জেলার মুখ উজ্জল করেছো । আজ তোমাদের রত্নগর্ভা মা বেঁচে থাকলে তার আনন্দ হতো সবচাইতে বেশি ।ওগো দেবী তুমি স্বর্গ থেকে তোমার আদরের মেয়েদের আশির্বাদ কর ।[ কান্না ]
কবিতা ও কল্পনা- বাবা তুমি কাঁদছো বাবা ?
বিমল- না মা না আর আমি কাঁদবো না । এবার আমি তোমাদের গর্বে আনন্দে প্রান খুলে হেঁসে বলবো ওগো বাংলার মানুষ, তোমরা দেখে যাও মেয়ে অভিশাপ নয়-মেয়ে ঈশ্বরের আশির্বাদ ।ওগো মা বাবা গন তোমরা মেয়েদের আর অবহেলা করোনা-তোমরা আর ঘুমায়ে থেকো না ।তোমরা ওঠো চেয়ে দেখো আজ সারা বাংলার মেয়েরা শুরু করেছে মুক্তির এক
সকলে-“নব জাগরন”
[ সকলে হাতের উপরে হাত তোলে দৃশ্য ছবি হয় ]
বি.ডি.ও.- সত্যিই “নবজাগরন” ।পিছিয়ে পড়া পুরুলিয়া জেলার বারাবাজার ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রামগুলো মেয়েদের সক্রিয় অংশগ্রহনে শুরু হেয়েছে এক “নবজাগরন” ।এই “নবজাগরন” কে প্রতি প্রান্তে পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের সকলের ।আসুন হাতে হাত মিলিয়ে আমরা প্রতিটি গ্রামে জ্ঞানের আলো পৌছে দিয়ে রচনা করি এক-“নবজাগরন” ।
[ যবনিকা ]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন